পুতুলনাচের ইতিকথা:
সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্কতার সমপাতন ঘটিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮—১৯৫৬ খ্রি.) বাংলা কথাসাহিত্যকে বিশ্ব মানসম্পন্ন শিল্পের স্তরে উন্নীত করেন। শিল্পী—জীবনের প্রথমার্ধে মানিক বিশ্ববিশ্রম্নত মনঃসমীক্ষণ—তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬—১৯৩৯ খ্রি.) দ্বারা বিপুলভাবে ভাবিত হয়েছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে কথাসাহিত্যে নতুন একটি যুগ সৃষ্টি করা সম্ভবপর হয়েছিল। মানিক—প্রতিভার শীর্ষবিন্দুস্পর্শী উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬) ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণতত্ত্বের শিল্পিত রসভাষ্য হিসেবে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
পুতুলনাচের ইতিকথার কেন্দ্রীয় চরিত্রদুটির— শশী ডাক্তার এবং কুসুমের— জীবনেতিহাস আপাতবিচ্ছিন্ন কোনো প্রণয়কাহিনি নয়, বরং চিরকালীন মানবজীবনের প্রেমাকাক্সক্ষার চিরায়ত বৃত্তান্ত। তবে জীবনকে দেখবার এবং সেটি নির্মাণ করবার ক্ষেত্রে মানিক প্রথম থেকেই ভিন্ন পথের পর্যটক। প্রেমকে তিনি কোনো অলৌকিক মহিমা দান করেননি— বরং প্রেমের নেপথ্যে তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় থাকতে দেখেছেন বৈজ্ঞানিক জৈবরসায়ন— লিবিডোর ঊর্ধ্বচাপ এবং নিম্নচাপ।
জীবনানুভূতির তীক্ষ্নতা ও তীব্রতা দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এ উপন্যাসে দেখিয়েছেন যে, প্রণয়যুগলের মনোরাজ্যে সদাসর্বদা জোয়ারভাটার টানাপোড়েন চলে। উপন্যাসের শুরুতে কুসুমের প্রেম—আবেগে যখন জোয়ারের প্রাবল্য, শশী ডাক্তারের আবেগে তখন ভাটার শিথিলতা বিরাজমান। উপন্যাসের শেষের দিকে গিয়ে শশী যখন আবার প্রণয়—উত্তাপে কুসুমকে পেতে চায়, প্রত্যাখ্যাত হতে হতে কুসুমের প্রেমে তখন শৈত্য নেমে এসেছে। ভয়াবহ এ মনোজাগতিক বিপর্যয়ে দুজন তখন গ্রস্তÑ কাউকে কেউ যেমন কাছে টানতে পারে না, আবার ঠেলে দিতে পারে না দূরেও। সান্ত্বনাশূন্য এমন বিপর্যস্ত প্রণয়কাহিনির সাথে বাংলা উপন্যাস—পাঠকের কোনো পূর্বপরিচয় নেই। চিরায়ত বাংলা উপন্যাস হিসেবে পুতুলনাচের ইতিকথার সাফল্য ও স্বাতন্ত্র্য এখানেই।