ভূমিকাঃ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ একজন প্রধান সৈনিক। এইরকম আমরা ভাবছিলাম, তখন শ্রদ্ধেয় শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বললেন যে, তিনি প্রধান শহীদও, কারণ যখন তাঁর বসতবাড়িতে সৈন্যরা আক্রমণ চালায় তখন কোনো মানুষ নয়, দেওয়ালে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের ছবিটির বুকে তারা গুলি করে ও ছবিটি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। প্রথম যখন শুনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে পারে না এইরকম একটা ফতোয়া জারি হয়েছে ও তাঁরা অন্তরের দুর্দমনীয় আবেগে বিপদের ঝুঁকি নিয়েও যে নিষেধ অগ্রাহ্য করছেন, রবীন্দ্রনাথের শিষ্যা হিসাবে তখন থেকে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এক গভীর একাত্মতা অনুভব করছি। রবীন্দ্রকাব্য যেমন মানুষের চেতনার পর্বে পর্বে প্রবেশ করে তার পরিবর্তন ঘটায়, তাকে অন্য মানুষ করে তোলে।
রবীন্দ্রকাব্য যে পড়েছে, আর যে পড়েনি তাদের মানসলোকের স্তরভেদ ঘটে যায়। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বেরও তেমনি প্রভাব ছিল। অর্থাৎ মানুষ রবীন্দ্রনাথ, কবি, সুরকার ও শিল্পী রবীন্দ্রনাথের মতোই আশ্চর্য পুরুষ । তাঁর জীবন ও কাব্যে বিরোধ ছিল না শুধু নয়, তাঁর জীবনই ছিল কাব্য। তাঁর দীর্ঘ আশি বছরের জীবনের শেষ পনের বছর তাঁকে খুব নিকট থেকে দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার কাহিনী আমি নানাস্থানে লিখেছি; কারণ মানুষ রবীন্দ্রনাথের কথা আমাদের পরে বলবার কেউ থাকবে না। বর্তমান প্রবন্ধ সংকলনের প্রবন্ধগুলি নানা সময়ে নানা বিষয়ে রচিত হলেও তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের পরিচয়ই প্রধান্য পেয়েছে। বহুদিনের সাধ ছিল বাংলাদেশের মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথের জীবন সম্বন্ধে কিছু বলব, ‘মুক্তধারা’ তার উপায় করে দিয়ে আমায় বাধিত করেছেন।