“প্লেটোর সিম্পোজিয়াম” বইটির সম্পর্কে কিছু কথা:
‘প্লেটো’ বা ‘প্লাতু’-র নাম সমগ্র মুসলিম জাহানে ‘আফলাতুনরূপে বিখ্যাত। তার জীবনদর্শন, সমাজচিন্তা ও যুক্তিপ্রণালী শুধু ইউরােপ কেন, বহু শতাব্দী ধরে উত্তর-আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া ও দূর প্রাচ্যকেও প্রভাবিত করেছে। প্লেটো ছিলেন মহাপুরুষ সক্রেটিস বা ‘সুবাদ’-এর শিষ্য, আর আরিস্টোটল বা আরস্তু’-র শিক্ষাগুরু। এই তিন মহামনীষী খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিক সভ্যতাকে সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত করে গিয়েছেন। | সক্রেটিস নিজে তার চিন্তাধারা সম্বন্ধে কোনাে পুস্তকাদি লিখে না গেলেও প্লেটোর রচনাবলি থেকে তার শিক্ষা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে অনেক কথাই জানতে পারা যায়; আর তিনি তাঁর শিষ্যদের ওপর ও সমসাময়িক সমাজের ওপর কী বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, সে পরিচয়ও পাওয়া যায়। এখানে আমরা কেবল প্লেটোর ‘সিম্পােজিয়াম’ বা ‘আলােচনা-উৎসব’ সম্বন্ধেই দুই-একটা কথা বলবার চেষ্টা করব। বইখানার বিষয়বস্তু। হচ্ছে ‘প্রেম-প্রশস্তি। প্রশস্তি করছেন কয়েকজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ব্যক্তি, এর মধ্যে রয়েছেন কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, দার্শনিক, প্রেমিক, বৈজ্ঞানিক, হাস্যরসিক। এঁদের মধ্যে সক্রেটিসও একজন। লম্বা লম্বা একটানা বক্তৃতা একঘেয়ে হয়ে যেতে পারে, এ জন্য প্লেটো অত্যন্ত নিপুণভাবে বক্তৃতায় মাঝে মাঝে কিছু কিছু কথাবার্তার অবতারণ করেছেন,—বিশেষ করে দুই বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে বেশ উপভােগ্য আলাপের সাহায্যে পরিস্থিতিটা হালকা করে নিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকতাও রক্ষা করেছেন, প্রত্যেক বক্তার বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বেশ স্বতন্ত্র হয়ে ফুটে উঠেছে। আবার, বেতাল পঞ্চবিংশতি, কাদম্বরী, হাতেম তাই, আরব্য উপন্যাস প্রভৃতির মতাে গল্পের মধ্যে গল্প বলা হয়েছে। তাই আলােচনা সভায় বাস্তবেই হােক, কিংবা প্লেটোর কল্পনায়ই হােক—যে আলােচনা হয়েছিল, তার বর্ণনা আরিস্টোডেমাস নামক সক্রেটিসের জনৈক শিষ্যের কাছ থেকে শুনে আপােলােডােরাস নামক এক ব্যক্তি আবার তার কোনাে অনামিত বন্ধুর কাছে হুবহু বিবৃত করছে। এতে কথক মাঝে মাঝে ‘ঠিক মনে পড়ছে না’, ‘আরিস্টোডেমাস যেমন বলেছিল’ বা ইত্যাকার কথা দিয়ে বক্তৃতার একঘেয়েমি লাঘব করবার সুযােগ পেয়েছে। | আর একটি কথা বিশেষ উল্লেখযােগ্য। সক্রেটিসের উন্নত চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তােলাও এই কথােপকথনের একটি প্রধান উদ্দেশ্য। সুনিপুণ আর্টিস্ট ও সংলাপ-বিশেষজ্ঞ প্লেটো এমন চমৎকারভাবে সামঞ্জস্য রক্ষা করে আলােচনার বিষয়বস্তু ‘প্রেম-প্রশস্তি’র সঙ্গে সঙ্গেই আভাসে-ইঙ্গিতে সক্রেটিস-চরিত্রের নানা দিক উদ্ঘাটিত করেছেন যে, তা সত্যই আশ্চর্য মনে হয়। শেষের দিকে কিছুটা পানােন্মত্ত এলসিবিয়াডিসের চরিত্র সংযােজিত করে তাকে দিয়ে বিশেষ করে সক্রেটিসের প্রশংসা বর্ণনা করানাে হয়েছে। এতে লাভ হয়েছে এই যে, কিছুটা অতিশয়ােক্তি বা সাধারণ রুচিবিরুদ্ধ হয়ে পড়লেও, বক্তার তৎকালীন অবস্থা বিবেচনা করে এ বক্তৃতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও চলে।