মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট গল্পসংগ্রহের মধ্যে কিছু প্রথম শ্রেণীর গল্প আছে। প্রেম ও দাম্পত্য-সম্পর্কমূলক গল্পগুলোই প্রধান, কিন্তু পারিবারিক জীবনের অন্যান্য দিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার বিষয়ও উপেক্ষিত হয়নি। উপেক্ষিত হয়নি মানুষের চিরায়ত প্রবৃত্তি, রিপু আর অন্ধকারও। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ বইটি মূলত সেরকম কিছু গল্প নিয়েই সাজানো।
প্রথম গল্প ‘প্রাগোইতিহাসিক’-এ আমরা দেখতে পাই, আদিম তাড়নায় তাড়িত হয়ে ভিখু কী করে পাঁচিকে নিয়ে পালিয়ে যায়। সেজন্যে খুনের মতো অতি গর্হিত কাজ করতেও ভিখুর বাধে না। লেখক মানবের এই আদিম, অলঙ্ঘনীয়, উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- “যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচি পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং সে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক। পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনদিন পাইবেও না।”
বিশেষ অবস্থা সম্পর্কে আমাদের একটা সাধারণ, ভাসাভাসা রকম জ্ঞান থাকে। লেখক এই সাধারণ অভিজ্ঞতার সূক্ষতর স্তরগুলো, ভাবের জোয়ার-ভাটার নিখুঁত রেখাচিত্রগুলো উদঘাটন করেছেন। প্রকৃতি’ গল্পের সমস্যা তাই আরও একটু জটিল। বড়লোক হতে গরীবে পরিণত অমৃত দশ বছর পর আবার সম্পদ অর্জন করেও তার তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে একটু বাঁকাচোরা, বিকৃত মনোভাব নিয়ে কলকাতায় ফিরেছে। এই মনোভাবের প্রধান উপাদান- ধনীর প্রতি বদ্ধমূল বিরাগ ও দরিদ্রের প্রতি একপ্রকার ভাববিলাসমূলক সহানুভূতি; মধ্যবিত্তের প্রতি শ্রদ্ধা তার এই নতুন মনোভাবের মেরুদণ্ড। কিন্তু শেষে দেখা গেল যে, তার পূর্ব হিতৈষী এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে পুনর্মিলন তার মনে তৃপ্তির পরিবর্তে ক্ষোভই জাগাল। “দারিদ্র্য যদি সুনীতির না সহিয়া থাকে, টাকা সুমতির সহিবে কেন?” -এই প্রশ্ন বারংবার তার হৃদয়কে বিদ্ধ করল। ‘ফাঁসি’ (প্রাগৈতিহাসিক) লেখকের আর একটি চমৎকার গল্প। ফাঁসির আসামী খালাস পেলে তার মনে যে এক বিভ্রান্তিকর আন্দোলনের সৃষ্টি হয় তা আমরা সাধারণভাবে জানি। এই গল্পে এমনই অবস্থাপন্ন এক শিক্ষিত গণপতির মানসিক বিপর্যয়ের স্তরগুলি খুব সূক্ষ্মভাবে আলোচিত হয়েছে। খালাসের দিনের সন্ধ্যায়, পরিবারের লোকদের সাথে পুনর্মিলনের সময় তার মনোভাব নিছক মুক্তির উল্লাস বা প্রিয়জন মিলনের আনন্দ নয়, বরং তা নানা রকম সূক্ষ্ম ও জটিল প্রতিক্রিয়ার সমষ্টি। এই গল্পসংগ্রহে কয়েকটি গল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভ্যস্ত রচনারীতির সুন্দর উদাহরণ হলেও মোটের উপর সমস্ত গ্রন্থটিতে অগ্রগতির অসন্দিগ্ধ প্রমাণ আবিষ্কার করা কঠিন। ছোট গল্প ও উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে নানামুখী বৈচিত্র্য ও আশ্চর্য মৌলিকতা দেখিয়েছেন, সেটাই তাঁকে আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে একটা শ্রেষ্ঠ আসনের অধিকারী করে রেখেছে।