একুশের সাড়া জাগানাে প্রথম কবিতা কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’র জনক মাহবুব উল আলম চৌধুরী উনআশি বছর জীবনে নানা বিষয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে বহু কবিতা, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সম্পাদনা করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশিত প্রথম মর্যাদাবান মাসিক পত্র ‘সীমান্ত’ (১৯৪৭-১৯৫২)। সত্তর দশকে সম্পাদনা করেন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্বাধীনতা’ (১৯৭২১৯৮২)। দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে একই মেল-বন্ধনে মিলিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলার গহিরা গ্রামে আসাদ চৌধুরী পরিবারে তার জন্ম । ১৯৪২ সালে ভারত-ছাড়াে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন ছাত্র কংগ্রেসের কর্মী হিসেবে। ১৯৪৩ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় আত্মনিয়ােগ করেন। ১৯৪৬-১৯৫০ সাল পর্যন্ত দেশে সমস্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে তিনি চট্টগ্রামে বিরাট আন্দোলন গড়ে তােলেন। ১৯৫০ সালে তিনি চট্টগ্রামে দাঙ্গা-বিরােধী সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন এবং বহু প্রশংসিত দাঙ্গাবিরােধী ‘সীমান্ত প্রকাশ করেন। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামের হরিখােলার মাঠে ১৬ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলনের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। একই বছর কুমিল্লায় যে সাংস্কৃতিক সম্মেলন হয়, সেই সম্মেলনে চট্টগ্রামের প্রায় ৫০ জন শিল্পী-সাহিত্যিক তাঁর নেতৃত্বে যােগদান করেন। সম্মেলনে অনুষ্ঠিত নজরুল সঙ্গীতের আসর তিনি উদ্বোধন করেন। ‘৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট কর্মী শিবিরের আহ্বায়ক ছিলেন। একই বছর ঢাকায় কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে চট্টগ্রাম থেকে শতাধিক শিল্পীসাহিত্যিকের যে প্রতিনিধি দল যােগদান করে মাহবুব উল আলম চৌধুরী তার দলনেতা ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামে প্রান্তিক নব-নাট্যসংঘ এবং কৃষ্টিকেন্দ্রের প্রাণ-প্রতিষ্ঠাতা। কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ তাঁর উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থ। আবেগধারা’ তার ছােটবেলায় লিখিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া চল্লিশ এবং পঞ্চাশ দশকে ‘ইস্পাত’ এবং অঙ্গীকার’ নামে তাঁর দু’টি কাব্যগ্রন্থ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। তিনি হুমায়ুন কবিরের ভূমিকা সংবলিত ‘দারােগা’ ও ‘আগামীকাল’ নামে দুটি নাটকও লেখেন। ১৯৪৬ সালে ‘বিষের নেশা’ নামের একটি উপন্যাসও লিখেছেন। ‘৪৭ সালে লিখিত তাঁর পুস্তিকা ‘বিপ্লব’ তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতাও পাকিস্তান সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং তাঁর নামে হুলিয়া বের হয়। ‘৫৬ সালে মিশরের মুক্তিযুদ্ধ’ নামে আরাে একটি পুস্তিকা চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়া একশ’ কবিতা সংবলিত কাব্যগ্রন্থ ‘সূর্যাস্তের রক্তরাগ’ (২০০৪), শিশু-কিশােরদের জন্য ছড়ায় ছড়ায় (২০০৪) নামের একটি ছড়ার বই, সীমান্ত সংকলন (জুন ২০০৫), কাব্যগ্রন্থ সূর্যের ভাের’ (২০০৬), প্রবন্ধ সগ্রহ ‘জাতীয় মুখশ্রী’ (২০০৬) প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমী তাঁকে ফেলােশীপ প্রদান করে সম্মানিত করে। ২০০১ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তাকে একুশের পদক ও সংবর্ধনা প্রদান করে। তিনি তৃতীয় স্বাধীনতা বইমেলা (২০০৪), চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সম্মাননা পদক (২০০০), সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট (২০০২)-এর পক্ষ থেকে সংবর্ধনা ও পদক পেয়েছেন। এছাড়াও তিনি ঢাকা এবং চট্টগ্রামে বহু স্বর্ণপদকসহ সংবর্ধনা লাভ করেছেন। ব্যাপক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলায় হয়ে উঠেছিলেন একজন কিংবদন্তী।

লেখক সম্পর্কে কোন জিজ্ঞাসা থাকলে আমাদেরকে জানান