কুয়াশা জমেনা; কিন্তু পশ্চিম আকাশে কুয়াশার মতাে একটা ধোয়াটে আবরণ ফ্যাকাশে করে তােলে গােধূলির রং। সারাঘরে ছায়া-ছায়া পরিবেশ, তাই জানালার ওপরে আয়নাটা রেখে কালাে হাড়ের মােটা ককই দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন বিলকিস বানু, তাঁর মুখটাও পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে। আয়নার ভেতরে তিনি দেখেন নিজেকে, রুজোড়া বাকা, টানা টানা চোখ, এবং চোখের পুতুলি কালাে; গালের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে নি এখনাে; চুল এখনাে কোমরের কাছে গিয়ে পড়ে। সঁইতিরিশটি বছর কম নয়, বিশেষত এ দেশের মেয়ের জন্য; কিন্তু এখনাে একটি চুলেও পাক ধরে নি। বুকের ভেতরে কি একটা অনুভূতি রিণরিণিয়ে ওঠে, সিঁথি কেটে দু’ধারে চুলগুলাে পাট করে ছেড়ে দিলেন। এটা দোতালার উত্তর দিকের কামরা। নীচে দেখা যাচ্ছে, লালফিতেয় চেলী করে বাধা চুল, সরু বেগুনী পাড়ের শাদা শাড়ি পরণে, ফুলের চারাগুলােতে পানি দিচ্ছে পারু, পারভিন। তার নিজেরই অন্য একটি সংস্করণ যেন। যেমন চেহারা, তেমনি কথাবার্তা, চলার ভঙ্গি। হঠাৎ দু’জনকে দু’বার দেখলে ভুল করার সম্ভাবনা আছে।
ছেলেদের প্রতি মা’য়ের টান বেশি, এ তাে চিরন্তন রীতি; অথচ খােকনকে কোনদিন বিশেষ সহ্য করতে পারেন নি। বরং ওর প্রতি একটা জটিল বিতৃষ্ণা। এতদিনে স্পষ্ট হয়েছে, ও তাে রীতিমতাে অবৈধ সন্তান। নানা উপায়ে ওর বাপ তাকে বিয়ে করে নিল ঠিক, কিন্তু বিয়ে করলেই তাে সম্পর্ক বৈধ হয় না? তখন বয়েস মাত্র পনেরাে বৎসর, প্রথম রাতেই বলৎকার করেছিল লােকটা, এবং তারই ফল এই ছেলে। পাশবিকতা থেকে যার জন্ম, আইনসঙ্গত স্বামীর ঔরসজাত হলেও, সে অবৈধ ছাড়া আর কী? অনভিপ্রেত সে, রক্তচোষা, পেটের ভেতরে বেড়ে উঠে দেহটা কংকাল করে তুলেছিল। জিভ হলদে টিংটিঙে হাত-পা বাঁচবার কোনাে লক্ষণ ছিল না। কেবল তাকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন একজন, দিবারাত্রির অক্লান্ত সাধনায়। ডাক্তার,-না, তার নাম মনে পড়ছে না।
বাড়তে বাড়তে থােকন হয়েছে ঠিক ওর বাপেরই মততা, তেমনি গাট্টাগােট্টা; হিংস্র প্রকৃতির। এমন জানলে হয়তাে ওকে বাচিয়েই রাখতেন না।