পটভূমি আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের পটভূমিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে বাঙালি মুসলমানদের অবদান ছিল অপরিসীম। পিছিয়ে-পড়া পূর্ব বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে শামিল হয়েছিল তাদের আর্থ-সামাজিক মুক্তির প্রত্যাশায়। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পূর্ব বাংলার জনজীবনে নেমে আসে নতুন দুর্ভোগ। পাকিস্তানি শাসক চক্র পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে না গিয়ে সীমাহীন শােষণ ও সম্পদ লুণ্ঠন প্রক্রিয়া শুরু করে। ধর্মের জিগির তুলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়। ভারতীয় এজেন্ট’- এই ধুয়া তুলে এদেশের সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন চালাতে থাকে। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জেল, জুলুম, নির্যাতন আর হুলিয়ার শিকার হন। মুসলিম লীগ সরকারের প্ররােচনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে অগণিত সংখ্যালঘু পরিবার দেশত্যাগ করে। এই আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার সরকারবিরােধী রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে ওঠে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়, অর্থনৈতিক মুক্তি, বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, চিরায়ত ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে জনগণের রাজনৈতিক ঐক্য। ১৯৪৮-৫২ ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ২১ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট। চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ভূমিকা পাকিস্তানের ইতিহাসে এক তাৎপর্যময় অধ্যায়ের সূচনা করে। এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে দেশে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার সূচনা হয়। নির্বাচনের সামগ্রিক পটভূমি, নির্বাচনের ফলাফল, রাজনীতিতে এর প্রভাব, এবং আজকের বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার আলােকে আলােচনার সূত্রপাতই এই গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য। বাংলাদেশের নির্বাচনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অধীনে সীমিত ভােটাধিকার ভিত্তিতে ১৯২৩ সালে এ দেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস এ নির্বাচন বয়কট করলেও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন স্বরাজ্য পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং বঙ্গীয় কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বাংলার উদীয়মান আইনজীবী ও রাজনীতিক বরিশালের এ. কে. ফজলুল হক ১৯২১ সালের অসহযােগ-খেলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দৈনিক নবযুগ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি ১৯২৩ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং বরিশালের স্বনামধন্য রাজনীতিক অশ্বিনীকুমারের সমর্থনে নির্বাচিতও হন।