কবি:
কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮—১৯৭১ খ্রি.)—এর সাহিত্যজীবন শুরু হয়েছিল কাব্যরচনা দিয়ে— ১৯২৬ সালে ত্রিপত্র কাব্যগ্রন্থ লিখে। অথচ এর পরে উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ, নাটক, প্রবন্ধগ্রন্থ, আত্মজীবনী ও ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে একাধারে লিখেছেন ১৪১টি গ্রন্থ— কিন্তু কবিতা আর লেখেননি। তারপরেও ‘কবি’ শব্দটির সঙ্গে তারাশঙ্করের নিকটসূত্রিতা আছে। এই সংশ্লিষ্টতা কেবল তাঁর, ‘কবি’ শীর্ষক উপন্যাস রচনার জন্য নয়, এ উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র একজন কবি বলে নয়, কিংবা এই বইয়ে মাঝেমাঝেই কবিতা খচিত আছে বলেও নয়— বরং কবি শব্দটির সঙ্গে তারাশঙ্করের এই নৈকট্য কবিজীবনের চিরায়ত প্রকৃতি রূপায়ণের মধ্যে অন্তর্নিহিত। তাঁর রচিত কবি (১৯৪৪) কেবল একজন কবির জীবনকে মূল উপজীব্য করে লেখা প্রথম বাংলা উপন্যাসই নয়, বরং এটি দারিদ্র্যলাঞ্ছিত, সমাজতাড়িত, নিয়তিপীড়িত, প্রেমতৃষিত কবিদের চিরকালিক জীবনেতিহাস হিসেবে অনন্যসাধারণ এক কালজয়ী রচনা।
‘বহিঃস্থ’, ‘বহিরস্থিত’ শব্দগুলো কবিদের সঙ্গে বেশ মানিয়ে যায়। কবি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ঠিক তেমনই একজন অন্ত্যজ শ্রেণির কবিয়াল। তার পারিবারিক প্রকাশ্য পেশা ডোম বলে পরিচিত হলেও তাদের গুপ্ত পেশা ডাকাতি; অথচ নিতাই তার কোনোটাই না—করে কবিগান গেয়ে বেড়ায়। কবিরা প্রেমে পারদর্শী হলেও পরিণয় বন্ধনে বন্দি হতে অনাগ্রহী— নিতাইও তেমনই। নিতাইয়ের দুইজন প্রণয়িনী— ঠাকুরঝি কিংবা বসন্ত কাউকে নিয়েই সংসার—গঠনে তাকে উদ্যোগী হতে দেখা যায় না। এই উপন্যাসের বিষাদাত্মক পরিণতি ঘনীভূত হয় বসন্ত এবং ঠাকুরঝির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তখন কবিয়াল নিতাইচরণের ভালো না—লাগে কাশীবাস, ভালো না—লাগে কাব্যসাধনা।
কবিদের অন্তস্বর্ভাব, ত্রিশঙ্কুদশা এবং তাদের মনোজাগতিক রক্তক্ষরণের ইতিবৃত্ত হিসেবে কবি চিরায়ত বাংলা উপন্যাস হিসেবে শাশ্বত সৃষ্টি।