পথের পাঁচালী
পথের পাঁচালী মানে পথের গল্প। কিন্তু এই পথটা কিসের, গল্পটাই বা কার? প্রশ্নটা যতটা সরল, উত্তরটা ততটাই জটিল— তবে একেবারে অনির্ণীত নয়। কেননা, কান টানলে যেমন মাথা আসে, কোনো শিল্পের শেকড় সন্ধান করতে গেলে তেমনইভাবে প্রসঙ্গসূত্রে অনিবার্যভাবে চলে আসে শিল্পীর জীবনদৃষ্টি এবং শিল্পবোধের প্রসঙ্গটি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪—১৯৫০ খ্রি.)এর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস পথের পাঁচালী (১৯২৯)র এই পথ এবং তার পথিক তাই আভাসযোগ্য। বিভূতি—বিশারদদের মতে, এই পথ হচ্ছে জীবন—পথ— মানুষের, গোটা জীবন যেটি অসরল, দুর্গম এবং কণ্টকাকীর্ণ; আর এই পথের পর্যটক হচ্ছে মানুষ— human being।
মহাকাব্যিক উপন্যাস পথের পাঁচালীর কেন্দ্রীয় চরিত্র অপু। উপনিষদীয় চিন্তাধারায় আবিষ্ট ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ তাঁর সমসাময়িক অপরাপর কথাশিল্পীদের মতো নঞর্থক দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎ এবং জীবনকে দেখেননি। তাই তাঁর কাছে জীবন অবহনযোগ্য ভাবনাসূত্রে দুর্বহ হলেও কল্লোলযুগীয় বিনাশভাবনায় উন্মূলিত নয়, বরং জগৎসংসারে ক্রমশ ঘনীভূত অন্ধকারে নিমজ্জমান থেকেও অন্ধকার থেকে উৎসারিত আলোকরেখার দিকনির্দেশনা তিনি অনুভব করেছেন সত্তার গভীর অন্তর্দেশ থেকেই— অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতোই।
পথের পাঁচালী সমগ্রতাসন্ধানী প্রতীকী উপন্যাস। পথের পাঁচালীতে অপু এবং বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালীন বিপন্ন পৃথিবীতে মানুষ প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সংশ্লিষ্ট এবং সমার্থবিশিষ্ট। অপুর জন্ম গ্রামে, তার সংগ্রাম ও পরিপুষ্টি শহরে। বিশ শতকে বাঙালি মধ্যবিত্তের গ্রামীণ তৃণমূলসংলগ্নতা এবং তাদের শাহরিক শাখাবিস্তার যুগপৎভাবে এ উপন্যাসে রূপায়িত হতে দেখি। এভাবে, কালকে ধারণ করে কালোত্তীর্ণ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি সংখ্যক রচিত হয়নি।