“দশটি উপন্যাস” বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা:
মােহিতলাল মজুমদার ‘ঝিন্দের বন্দী মেউিপন্যাসটি পড়ে একটি চিঠিতে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন: “আপনার রচনায় যে ধরনের কবিত্বময় কুশলী কল্পনার অবাধ-সুন্দর গতি আছে…তাহা আমার ব্যক্তিগত রুচির পক্ষে বড়ই উপাদেয়।…আপনি রােমান্সের ভক্ত, সেই রােমান্স বাঙালীর প্রকৃতিগতবাংলা সাহিত্যে এই প্রবৃত্তি রুদ্ধ হওয়ায় কাব্য ও উপন্যাস জীবনীশক্তিহীন হইয়াছে।” রােমান্সের যে বিলীয়মানতার কথা মােহিতলাল সেদিন বলেছিলেন, বাংলা কথাকাহিনীতে তার উদগাতা বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে রমন্যাসের যে-বাতাবরণ রচিত হয়েছিল, তার প্রভাবে বাংলা কল্পকাহিনী বহুদিন পর্যন্ত। বঙ্কিমী-অনুশাসন থেকে মুক্ত হতে পারেনি। শরদিন্দু সাহিত্যসৃষ্টিতে বঙ্কিমের মন্ত্রশিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ব্যোমকেশ-কাহিনীমালা বাদ দিলে শরদিন্দুর অন্যান্য উপন্যাস ও গল্পে রােমান্টিকতা দূরাভিসারী পাখির মতাে অন্য ভুবনে পাড়ি দিয়েছে। বিশেষত, ঐতিহাসিক উপন্যাস-গল্পে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটের কথা মনে রেখেও, শরদিন্দু এই জাতীয় কল্পকাহিনীতে রােমান্সের ভূমিকাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সমাজজীবন কিংবা জীবনের কোনও সমস্যা-সংকটকে নিয়ে তাঁর অন্যান্য উপন্যাসেও এই রােমান্স আবিষ্কার করেই তৃপ্ত হয়েছিলেন মােহিতলাল। তাঁর এই জাতীয় উপন্যাসের মুখ্য উপজীব্য নরনারীর প্রেম—এক দুর্নিবার। আকর্ষণের আধারে তা পরিবেশিত হয়েছে। সে-প্রেম কখনও দেহাতীত, কখনও শরীরী ইঙ্গিতে ভরপুর। আবার এই প্রেমকাহিনীর চিরায়ত ধারায় যে কত বৈচিত্র্য থাকতে পারে, তা শরদিন্দু অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছেন। মানবিক . প্রণয়কাহিনী সৃষ্টিতে তিনি যেমন অদ্বিতীয়, তেমনই এই উপন্যাসগুলিতে তিনি চিত্রিত করেছেন মানুষের বিরামবিহীন অভিযাত্রার ইতিবৃত্ত। প্রেম-অপ্রেম ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভেতর দিয়ে তাঁর চরিত্ররা কোথাও পৌছতে চেয়েছে— সেই অন্তর্গঢ় স্থানটি কখনও আলাে-অন্ধকারের ছায়াময় জগৎ, কখনও বা সত্যস্পর্শে পবিত্র এক ঐকান্তিক ভূমি। শরদিন্দুর লেখা এই পর্যায়ের দশটি উপন্যাস দাদার কীর্তি, বিষের ধোঁয়া, ঝিন্দের বন্দী, ছায়াপথিক, রিমঝিম, মনচোরা, বহু যুগের ওপার হতে, রাজদ্রোহী, অভিজাতক এবং শৈলভবন নিয়ে গ্রথিত হয়েছে এই অনবদ্য সংকলন।