লোকসংস্কৃতি” বইটির ‘ভূমিকা’ থেকে নেয়াঃ
প্রাচীনকালে বাংলাদেশে কৃষি সভ্যতা গড়ে ওঠার মূলে ছিল এ অঞ্চলের উর্বর ভূমি ও সুপেয় পানি। এখানে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় নদী। নদীগুলো নৌপথ রচনার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আস্তর্দেশিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৌপথ ব্যবহার করেই অষ্টাদশ শতকে বাংলাদেশ উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সুতিবস্ত্র মসলিন তৈরি হতো বাংলাদেশে। মসলিন ছিল। মোঘল সম্রাটদের প্রিয় বস্ত্র। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান মসলিনকে ব্যবহার করতেন ফ্যাশন হিসাবে। সোনারগাঁয়ের চিত্রিত ঘোড়া ও হাতি ছিল সারা ভারতবর্ষে জনপ্রিয়।
প্রাচীনকালে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামই ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ কারণে গ্রামের জনগণকে নিজেদের বাইরে যেতে হতো না। আশে-পাশের হাট বাজার ও মেলায় পাওয়া যেত প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র এবং শিশুদের খেলনা সামগ্রী। গ্রামে গ্রামে উৎপাদিত হতো কাঁসা পিতল-তামা, কাঠ-বাঁশ-বেত এবং লোহা-মাটির কারুপণ্য। বাংলাদেশের নকশিকাঁথার খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। নগরায়নের প্রভাবে কারুশিল্পীদের জীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি শ্রমিকদের চেয়েও তাদের দৈনিক গড় আয় অনেক কম। এ কারণেই হারিয়ে গিয়েছে অনেক কারুপণ্য। সম্প্রদায়গত পেশা পা বাড়িয়েছে অবলুপ্তির পথে।
আট বেহারার পালকি ডেকোরেশন পিস হিসাবে প্রবেশ করেছে ড্রয়িং রুমে। কাঠের তৈরি একতারা আর দোতারার মতো সংগীত যন্ত্রের কদর কমে গিয়েছে। তামা-কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র অপসাধিত হয়েছে নিজের স্থান থেকে। মাটির তৈজসপত্রের স্থান দখল করে নিয়েছে এ্যালুমিনিয়াম ও মেলামাইনের তৈজসপত্র। গ্রাম জুড়ে শুরু হয়েছে পরিবারের ভাঙন। নদীর ভাঙনের মতো ভেঙেছে কারুশিল্পীদের পেশা। কারিগরি উৎপাদন প্রথার স্থান দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি।