“কমিউনিস্ট পার্টির ইশতিহার” বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ
শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কমিউনিস্ট লীগের তখনকার দিনের অবস্থায় শুধু গুপ্ত সমিতি হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ১৮৪৭ সালের নভেম্বরে লন্ডন কংগ্রেসে নিম্নস্বাক্ষরকারীদের উপর ভার দেওয়া হলাে যে, পার্টির বিস্তৃত তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক কর্মসূচী প্রকাশের জন্য লিখে দিতে হবে। এইভাবে হয় পরবর্তী ইতিহারটির উদ্ভব। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কয়েক সপ্তাহ আগে ছাপা হবার জন্যে পাণ্ডুলিপিটি লন্ডনে গেল। জার্মান ভাষায় প্রথম প্রকাশের পর এটি জার্মানি, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় জার্মান ভাষায় অন্তত ১২ টি বিভিন্ন সংস্করণে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। এটি সর্বপ্রথম ইংরেজীতে প্রকাশিত হয় ১৮৫০ সালে, দি রেড় রিপাবলিকান, লন্ডন-এ, অনুবাদ করেন মিস হেলেন ম্যাকফারলেন। ১৮৭১ সালে আমেরিকায় অন্তত তিনটি বিভিন্ন অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ১৮৪৮ সালের জুন অভ্যুত্থানের কিছু আগে প্যারিসে এর ফরাসী অনুবাদ প্রথম প্রকাশিত হয়। আবার সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নিউইয়র্কের Le Socialiste-এ। আর একটি নতুন অনুবাদের কাজ চলছে। জার্মান ভাষায় প্রথম প্রকাশের কিছু পরে এর পােলিশ অনুবাদ লন্ডনে বের হয়। ষাটের দশকে জেনিভা শহরে প্রকাশিত হয় রুশ অনুবাদ। আর প্রথম প্রকাশের অল্প কিছুদিন বাদেই ডেনিশ ভায়ায়ও।
গত পঁচিশ বছরে অবস্থা যতই বদলে যাক না কেন, এই ইশতিহারে রচিত সাধারণ নীতিসমূহ আজও মােটের উপর আগের মতনই সঠিক। এখানে ওখানে কিছু-কিছু অনুপুঙ্খ বর্ণনার মানােন্নয়ন করা যেত। যেমন- ইশতিহারই বলেছে, নীতিগুলির ব্যবহারিক প্রয়ােগ সর্বত্র এবং সর্বসময় নির্ভর করবে তৎকালীন বিদ্যমান ঐতিহাসিক অবস্থার উপর এবং সেই কারণে দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে প্রস্তাবিত বৈপ্লবিক ব্যবস্থাবলীর উপর কোনাে বিশেষ জোর দেওয়া হয়নি। আজকের দিন হলে ঐ অংশটা অনেক দিক থেকে খুবই অন্যভাবে লেখা হতাে। গত পঁচিশ বছরে আধুনিক শিল্পের দৈত্যের মতাে পদক্ষেপে অগ্রগতির এবং তার সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর উন্নত ও বিস্তৃত পার্টি সংগঠন, বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ, প্রথম ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে এবং তারপর আরও বেশি, প্যারি কমিউনএ, যেখানে সর্বহারা শ্রেণী সর্বপ্রথম পুরাে দুমাসকাল রাষ্ট্রক্ষমতা অধিকারে পেয়েছিল, – এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে এই কর্মসূচী কিছু-কিছু অনুপুঙ্খ বর্ণনায় সেকেলে হয়ে পড়েছে। কমিউন একটা কথা বিশেষ করে প্রমাণ করেছে যে, “শ্রমিকশ্রেণী আগে থেকে তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্রটা শুধু দখল করেই তাকে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কাজে লাগাতে পারে না” (দ্রষ্টব্য: ফ্রালে গৃহযুদ্ধ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমিতির সাধারণ পরিষদের ঘােষণা, লন্ডন, টুভাল, ১৮৭১, ১৫ পৃষ্ঠা। সেখানে এই কথাটিকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে*) তাছাড়া এটা স্বতঃপ্রমাণিত যে, সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের সমালােচনাটি বর্তমান সময়ের হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ। কারণ এর বিস্তার মাত্র ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত। তাছাড়া বিভিন্ন বিরােধীদলের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্কের প্রসঙ্গে মন্তব্যগুলি (চতুর্থ অধ্যায়) যদিও নীতির দিক থেকে এখনও সঠিক হলেও, ব্যবহারিক দিক থেকে সেকেলে হয়ে গেছে। কারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুরােপুরি বদলে গেছে, আর ইতিহাসের অগ্রগতি সেখানে উল্লিখিত ঐ সব রাজনৈতিক দলের অধিকাংশকে এ জগৎ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছে।
কিন্তু, এই ইতিহার এখন ঐতিহাসিক দলিল হয়ে পড়েছে, এর অদল-বদল করবার কোনও অধিকার আর আমাদের নেই। সম্ভবত পরবর্তী কোনাে সংস্করণ বার হবে একটি ভূমিকাসহ যা ১৮৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সময়ের ফাক পূরণে সেতু বন্ধনের কাজ করবে।